তীরা –১ : নদী কোথায় তোমার ঘর ?
ছোট ভাইটাকে সাথে নিয়ে, দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর ঘাটে বসে বসে তীরা এক মনে ভাবতে থাকে। এই যে নদীর জল উজান হতে অবিরাম ভাটির দিকে বয়ে চলেছে। তার ইচ্ছা হয় এর উৎস কোথায় দেখতে। ভূগোলের বইতে পড়েছে, পাহাড় পর্বতে নাকি নদীর জন্ম।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দরাজ কন্ঠ কানে ভেসে আসে – “ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে”
সপ্তাহ খানেক পরেই একটা অভাবনীয় সুযোগ আসে নদীর উজানের দেশ গুলো দেখবার।
নানা, মাতৃ হারা তীরা ও তার ভাইকে নিয়ে পশ্চিমের এক আত্মীয়দের বাড়ি বেড়াতে রওনা দেয়।
ছোট নৌকায় ছই এর ভেতর পরিপাটি করে গোছানো বিছানা। নতুন চাদর আর নরম বালিশ ।
তীরা আয়োজন দেখে মহা খুশি। এক দৌড়ে নৌকায় উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আনন্দে নানাকে জড়িয়ে ধরে।
নৌকায় রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরে আলু ভর্তা দিয়ে নৌকায় রান্না করা গরম ভাত। মাঝির ছেলে রান্নায় পটু। আশ্বাস দেয় রাতে জেলেদের কাছ হতে টাটকা মাছ কিনে রান্না হবে।
মাঝি নৌকার হাল ধরে বসে উদাস মনে আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালী গান ধরেছে। পালে বাতাস লেগে তর তর করে নৌকা উজান গাঙ্গে ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলেছে।
তীরার আনন্দ ধরে না। ছইয়ের ভেতর বাইরে ছুটা ছুটি করে।ভাবে এবার দেখা যাবে নদীর পানি কোথা হতে আসে।
দুপুরে পরিশ্রান্ত মাঝি নদীর কিনারে গাছের ছায়ায় নৌকা থামিয়ে বিশ্রাম করে। নানা ও ভাই ঘুমিয়ে পড়ে। তীরার চোখে ঘুম নেই।
নদীর ঘাটে গ্রামের বধূরা ডুব দিতে আসে। ছই তোলা নৌকা দেখে নতুন বৌ এর মার বাড়ির কথা মনে পরে এবং দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
বিকেলে আবার নৌকা চলতে থাকে। এবার নৌকার পালে বাতাস লেগে দ্রুত চলতে থাকে। এর মধ্যে বেশ কটা নৌকা তাদের পাশ দিয়ে ভাটির দিকে চলে যায়।
নদীর বাঁক পেরোলেই স্কুল ঘর, পাশে খেলার মাঠে শিক্ষার্থীরা খেলছে। একটা নারকেল গাছ বাঁকা হয়ে নদীর পানি ছুঁই ছুঁই করছে। বাচ্চারা গাছ থেকে পানিতে লাফিয়ে পরছে।
নানা জেলের নিকট থেকে টাটকা মাছ কিনেছে। মাঝির ছেলে রাতের রান্নায় ব্যস্ত। আর আধা ঘন্টা পরে দিন শেষে রাত নামবে। মাঝি সন্ধ্যার পূর্বে তাহিরপুর বাজারে পৌঁছতে চায়। সেখানে যাত্রা বিরতি ।রাতটা বাজারের ঘাটে কাটাতে পারলে অনেকটা নিরাপদ।
তাহিরপুর পৌঁছার পূর্বেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। ছইয়ের ঝাঁপ বন্ধ করে বৃষ্টির ঝাপটা হতে আত্মরক্ষা করে তারা।
রাতের খাবার সংখিপ্ত করতে হল বৃষ্টিতে। নৌকা নিরাপদ স্থানে বেঁধে রেখে মাঝি বসে বসে পাহারা দেয়।
নরম বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে চোখে ঘুম নেমে আসতে চায়। ভাই ও নানা গভীর ঘুমে। তীরা কত কিছু ভাবতে থাকে। যদি আরও অনেক দূর যাওয়া যেত, নদীর উৎস দেখা যেত। পাহাড় হতে ঝর্ণার পানি মিলে নাকি নদী সৃষ্টি হয় ।
তীরা ভাবে এই নৌকায়, এ ভাবে সেখানে যাওয়া যাবে না। বড় হয়ে অন্য ভাবে যেতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
তীরা – ২ : নদী কোথায় তোমার দেশ ?
ছোট ভাই ও নানার কথাবার্তায় তীরার ঘুম ভাঙ্গে।
রাতের ঝড় বাদল কেটে গিয়ে নির্মল নীল আকাশ। সূর্য এই মাত্র উঠেছে।
নানা দোকান হতে গরম গরম পরটা এনেছে। চায়ের সরঞ্জাম নৌকায় আছে। এবার তাহিরপুর হতে পুনরায় নৌকা উজানের দিকে যাত্রা শুরু।
বাজারের চৌকিদার এসেছে সেলামী নিতে। তারা ঘাটের সব নৌকা পাহারা দিয়েছে।
বাতাসের গতিপথ উল্টো দিকে। পালে কাজ হবে না। মাঝি গুন টানছে। ছেলের হাতে হালের বৈঠা। তাদের গতিমাত্রা একেবারেই মন্থর। সামনে ফকিন্নী নদীর মিলন স্থল ।সেখান থেকে নদী দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে। এবার মাঝি গুন গুটিয়ে আবারো পাল তুলেছে।
মাঝির কষ্ট দেখে তীরার খারাপ লাগে। এখন আবারো স্বস্তি ফিরে আসে নৌকায়। নদীর পাড়ে অচেনা গ্রাম। পানের বরজ, আম কাঁঠালের বাগান ।তীরার ইচ্ছা করে নৌকা হতে নেমে ঐ সব অপরিচিত গ্রাম, আম বাগান দেখতে। মাঝিকে নৌকা থামাতে বলা যাবে না। বাতাসের গতিপথ পরিবর্তনের আগে যত বেশি পথ চলা যায়।
অবশেষে নানার গন্তব্যে নৌকা পৌঁছে। নদীর একেবারে কিনারে বাড়ি। নদীতে শানবাঁধানো ঘাট ।খবর পেয়ে বাড়ির সবাই ছুটে আসে নদীর ঘাটে। বড় খালা তীরাকে ও তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে মৃত বোনের জন্য ডুকরে কেঁদে ওঠে।
এমনি ভাবে নদীর উৎস দর্শনের প্রথম অধ্যায় শেষ হল।
এই দুই দিনে তীরা বুঝেছে, এত কষ্ট করে সামান্যই তারা অগ্রসর হতে পেরেছে। এভাবে কোন দিনই নদীর উৎসের কাছে যাওয়া যাবে না।
তবু শান্তনা এত টুকু, তাদের ঘাটের পানি এখান দিয়েই গিয়েছে। দীর্ঘ পথে চলতে গিয়ে কত গ্রাম, ঘাট অতিক্রম করেছে। অনেক সুখ দুঃখের কাহিনী এই নদী সাথে নিয়ে চলেছে এবং ঘাটে ঘাটে সেই সব কাহিনী শুনিয়েছে। শুনবার মন থাকলে নদীর অব্যক্ত কথাগুলো চুপি চুপি শুনতে পাওয়া যায় । তাই নদীর ঘর খুঁজতে উৎসে যাবার দরকার হয় না। নদীর ঠিকানা সর্বত্র, কেবল খুঁজে পাবার মত মন ও দৃষ্টি শক্তি থাকা চাই।. নদী ঘর ছাড়া, তার কোন ঠিকানা নেই।
তীরা – ৩ : তীরার পুনর্জন্ম
খালা বাড়ি হতে তীরা ফিরেছে এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে। অনেক অনেক ভূগোলের বইতে মনোযোগ করেছে।
বিশ্ব বিদ্যালয়ে শিক্ষা শফরের সুযোগ সে হাত ছাড়া করে না। পনেরো দিনের শফরে দিল্লি হয়ে গঙ্গার উৎসে যাবে তাদের দল। এ যেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। তবে সমস্যা হল দলে তাকে নিয়ে মাত্র দুই জন ছাত্রী। অন্য ছাত্রী, মালবিকা সদ্য বিবাহিতা। স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে তার যাওয়া।
তীরা তার বন্ধুর স্বামীকে অতি কষ্টে রাজি করায়।
শুরু হয় তাদের যাত্রার ব্রিফিং। গঙ্গার উৎস সম্পর্কে তাদেরকে বিষদ জ্ঞান দেওয়া হল।
যাত্রা কালে তীরা তার মনের মধ্যে সমস্ত শফরের ছবি এঁকে নেয়।
নদী সীমান্ত রেখার তোয়াক্কা করে না।বয়ে যায় অপন খেয়াল খুশি মত ।
স্কুলে সিন্ধুর পাঁচ উপনদী ও পদ্মার শাখা নদীর নাম কণ্ঠস্থ করেছে । গঙ্গার কথা তেমন জানা হয় নি।. আজ সে জানে,
গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ (cow face) ঝর্ণা হতে গঙ্গার জন্ম। উত্তরা খন্ডে Devprayag পর্যন্ত ভাগীরথী নামে প্রবাহিত হয়ে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করে । অলকানন্দার জন্ম Satopanth (true path) হিমবাহে ।. এ সব তাদেরকে দেখানো হয় হেলিকপ্টারের সাহায্যে। প্রকৃতির কী এক লীলা খেলা। আজ সে জানে হিমবাহে নদীর ঠিকানা।
গঙ্গা = উত্তর খন্ডের দেবপ্রয়াগ নামক স্থানে ভাগিরথী ও অলকানন্দা মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করে।
দীর্ঘ ২৫২৫ কিঃমিঃ পথ চলতে, অনেক উপ নদী গঙ্গায় পতিত হয়েছে এবং জল সরবরাহ করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – যমুনা, ঘার্ঘা, গোমতী, শন, মহানন্দা প্রভৃতি।
উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ এবং শেষে ফারাক্কা হয়ে বাংলাদেশে পদ্মা নামে আত্ম প্রকাশ।.
ফারাক্কার পূর্বে শাখা নদী ভাগীরথী – হুগলি নামে কোলকাতা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত। আরো অনেক শাখা নদী – মাথাভাঙ্গা, আড়িয়াল খাঁ, ইছামতি সৃষ্টির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়া।. *
** পদ্মা রাজশাহী, পাবনা হয়ে গোয়ালন্দের কাছে ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা নদী, যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়।
গোয়ালন্দ হতে পদ্মা নামে চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিশে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। গঙ্গা – বার বার নাম ও গতি পথ পরিবর্তন করলেও গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র ব- দ্বীপ সৃষ্টি করে ঐ এলাকার উর্বরতা বৃদ্ধি করেছে।
দীর্ঘ দুই সপ্তাহের কঠোর পরিশ্রম ও একাগ্রতার ফসলে তার জ্ঞান ভান্ডার পরিপূর্ণ এবং মনে প্রগাড় প্রশান্তি। তবে উৎস দেখার পর, তীরার অনুভব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। নদীর গোপন কথা আরও স্পষ্ট শুনতে পায়। নদী যেন বলতে চায়, আমাকে বাঁচাও, যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও।
তীরা জানে তারা নদী মাতৃক দেশের নাগরিক, নদী তাদের প্রাণ। নদী দূষণ মুক্ত রাখা সবার কর্তব্য। নতুবা প্রকৃতি ক্ষমা করবে না।
তীরা-৪ : তীরার শেষ পর্ব
তীরা আমার খুবই পছন্দের একটা চরিত্র। তার মাধ্যমে ভূগোল শিক্ষার আধুনিকায়ন করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু কিছু পরশ্রীকাতর মানুষের হিংস্রতা সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।
প্রথম বাধা আসে বিভাগীয় বাজেট সঙ্কোচনের মাধ্যমে। ফলে গবেষণার উন্নয়ন ব্যহত হল।
তবে বড় আঘাত আসে অভাবনীয় ভাবে। তহবিল তছরুফের কেলেঙ্কারি তার উপর প্রদান করা হয়।
পঁচিশ জন শিক্ষার্থী ও পাঁচ জন শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এক শিক্ষা শফরকে কেন্দ্র করে। রাজশাহী হতে কক্সবাজার শফর কর্মসূচি নির্ধারিত হল।
শিক্ষার্থীদের হতে চাঁদা সংগ্রহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদানের টাকা নিয়ে গঠিত ফান্ড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তীরার একজন অতি প্রিয় শিক্ষক।
তীরা কল্পনা করতে পারেনি, সেই প্রিয় ব্যক্তি বেহিসাবি টাকা খরচ করবে।
ঘটনাটি এরকম, কক্সবাজার হোটেলের ভারা দ্বিগুণ দেখানো হয়।।
শিক্ষা শফর শেষে তীরার প্রিয় শিক্ষক, মিথ্যা ভাউচারে তীরার অজান্তেই স্বাক্ষর নেয়। এবং উক্ত শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে তীরার নামে মিথ্যা অভিযোগ প্রদান করে।
এক দল পরশ্রীকাতর মানুষ এই সুযোগের অপব্যবহার করে এবং তীরার বিরুদ্ধে অর্থ অপচয়ের অভিযোগ আনে।
তীরা ক্ষোভে দুঃখে পদত্যাগ করে। এবং প্রিয় কর্মস্থল হতে বিদায় নেয়।
সে নতুন উদ্যমে নিজের সঞ্চিত অর্থ ও পিতার সম্পদের দ্বারা বেসরকারি ভাবে ছোট্ট একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
শেষে নিরুপায় হয়ে বিদেশে চাকুরী নিয়ে দেশত্যাগ করে।
সে বর্তমানে Geographic Society of Chicago এর একজন স্বনামধন্য সদস্য। আমাদের দূর্ভাগ্য এমন এক জন মানুষকে দেশ সেবা থেকে দূরে ঠেলে দিলাম।
(Disclaimer : রচনা-টি কোনোরূপ পরিমার্জন/পরিবর্তন ছাড়াই প্রকাশিত হলো। এটি লেখকের একান্তই নিজস্ব মত /ভাবের বহি:প্রকাশ এবং BCF-এর কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা বিহীন। )